ব্যবস্থাপনা কাকে বলে: বৈশিষ্ট, গুরুত্ব এবং কার্যাবলী বিস্তারিত আলোচনা

Share Knowledge

ব্যবস্থাপনা কাকে বলে: বৈশিষ্ট, গুরুত্ব এবং কার্যাবলী বিস্তারিত আলোচনা

বর্তমানে যে কোনো সংস্থা বা সংগঠনকে সঠিক ভাবে চালাতে হলে ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন হয়। কিন্তু ব্যবস্থাপনা আসলে কি বা কাকে বলে ? এটি কি শুধু শব্দ মাত্র। তাই আমরা এখানে জানব যে কোনো সংস্থাকে  ভালোভাবে চালাতে হলে  ব্যবস্থাপনার  গুরুত্ব, বৈশিষ্ট, এবং কার্যাবলী ইত্যাদি জানা  অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্লগ পোষ্টে আমরা আরও জানব যে কিভাবে ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কার্যকর এবং দক্ষতার সাথে সংস্থার ক্রিয়াকলাপকে সুচারুভাবে করা যায়।

ব্যবস্থাপনা কাকে বলে ?

ব্যবস্থাপনা হল একটি প্রকিয়া যার সাহায্যে যে কোনো সংস্থার পরিকল্পনা, সংগঠিত, কর্মী, নেতৃত্বদানকারী, এবং নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে সাংগঠনিক লক্ষ্যগুলিকে দক্ষতার সাথে এবং কার্যকরভাবে অর্জন করা । অর্থাৎ, যে কোনো সংস্থার মানুষ, অর্থ, এবং উপকরণকে দক্ষতা এবং কার্যকরভাবে ব্যবহার করে সেই সংস্থার লক্ষ্য অর্জন করা।  

ব্যবস্থাপনা সংজ্ঞা অনেকের মতে অন্য রকম হতে পারে। ব্যবস্থাপনার সংজ্ঞা কিছু বিশেষজ্ঞ এর মতে, যেমন –

১. হ্যারল্ড কুন্টজ (Harold Koontz)– এর মতে “ব্যবস্থাপনা হল আনুষ্ঠানিকভাবে সংগঠিত দলগুলির মাধ্যমে এবং মানুষের সাথে জিনিসগুলি সম্পন্ন কারার শিল্প”।

২. লরেন্স এ আপ্পলেয় (Lawrence. A. Appley)– এর মতে “ব্যবস্থাপনা হল অন্য লোকেদের প্রচেষ্টার মাধ্যমে ফলাফলের সিদ্ধি”।

৩. পিটার ড্রাকার (Peter Drucker)– এর মতে “ব্যবস্থাপনা হল পণ্য ও পরিষেবা উৎপাদনের সমস্যায় পদ্ধতিগত জ্ঞানের প্রয়োগ”।

৪. টেরি জি (Terry G)– এর মতে “ব্যবস্থাপনা হল লোক এবং সংস্থানগুলির ব্যবহার দ্বারা উদ্দেশ্যগুলি নির্ধারণ এবং সম্পাদনের জন্য পরিকল্পনা, সংগঠিত, কার্যকরণ এবং নিয়ন্ত্রণের একটি প্রক্রিয়া”।

সুতরাং, আমরা বলা যায় যে ব্যবস্থাপনা হল এমন এক কৌশল যা অন্যের মাধ্যমে কাজ করিয়ে নেওয়া যায় ।

ব্যবস্থাপনা কি একটি পেশা ?

হ্যাঁ, ব্যবস্থাপনা একটি পেশা হিসেবে বিবেচিত হয়। একটি পেশা সাধারণত নির্দিষ্ট জ্ঞান, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে গঠিত হয়, এবং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও তাই। পেশাগত ব্যবস্থাপনা একজন ব্যবস্থাপককে সংস্থার লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করতে সক্ষম করে তোলে।

ব্যবস্থাপনার বৈশিষ্ট্য (Characteristics of management):

১. লক্ষ্য-ভিত্তিক :

ব্যবস্থাপনার  উদ্দেশ্য হল যে কোনো সংস্থা বা সংগঠনের লক্ষ্য নির্ধারণ এবং অর্জন করা। লক্ষ্য নির্ধারণের ফলে সাংগঠনিক সম্পদ এবং কর্মচারীর কর্মদক্ষতাকে ব্যবহার করে উদ্দেশ্য অর্জন করা যায়।

২. চলমান কার্যকলাপ :

ব্যবস্থাপনা কোনো এককালিন কাজ নয়, বরং এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য ব্যবস্থাপনার কার্যকলাপ, যেমন- পরিকল্পনা, সংগঠিত, নেতৃত্ব, এবং নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদিকে পরিবর্তিত হতে হবে।

৩. বহুমুখী :

ব্যবস্থাপনা যে কোনো সংগঠনের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপকে অন্তর্ভুক্ত করে যেমন কাজ পরিচালনা, মানুষ, এবং অপারেশন ইত্যাদি। প্রতিটি দিক ভিন্ন পদ্ধতি এবং দক্ষতার প্রয়োজন হয়। উদাহরণ স্বরূপ, ব্যবস্থাপনার কাজ পরিচালনাতে  পরিকল্পনা, সংগঠিত, ও নিয়ন্ত্রণ করা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। মানুষের ক্ষেত্রে কর্মী ও নির্দেশনা, আর অপারেশনের ক্ষেত্রে সেই সংস্থার উৎপাদন, ক্রয় ও বিক্রয় ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ।

৪. গতিশীল:

ব্যবসার পরিবেশ পরিবর্তিত হওয়ায় ব্যবস্থাপনাকে গতিশীল হওয়া অত্যন্ত জরুরি। কারণ প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, বাজারের প্রবণতা এবং নিয়ন্ত্রণমূলক ঘোষণা ইত্যাদির ফলে ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন ধরনের কাঠামো দেখা দিতে পারে। তাই ব্যবস্থাপনা গতিশীল হওয়া উচিত ।

৫. দলগত কার্য :

ব্যবস্থাপনার সাহায্যে যে কোনো সংস্থার লক্ষ্য অর্জন করার জন্য কর্মীদের মধ্যে  দলগতভাবে কাজ করতে হবে । সফল ব্যবস্থাপনা নির্ভর করে কর্মীদের মধ্যে কার্যকর যোগাযোগ, সহযোগিতা ও দলগত কাজের উপর । সংগঠনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য পরিচালকদের অবশ্যই কর্মীদের মধ্যে শক্তিশালী সম্পর্ক এবং একটি সহযোগিতামূলক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।

৬. অস্পর্শনীয় :

ব্যবস্থাপনাকে দেখা ও স্পর্শ করা যায় না, কিন্তু তার দ্বারা কোন সংস্থার উন্নত উৎপাদনশীলতা বা উন্নত কর্মদক্ষতার প্রভাব দেখা ও অনুভব করা যায়।

৭. সিদ্ধান্ত গ্রহণ:

ব্যবস্থাপনার আর একটি প্রাথমিক দায়িত্ব হল সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া। কোনো সংস্থাতে কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য সঠিক তথ্য সংগ্রহ, বিকল্পগুলির বিশ্লেষণ, সর্বোত্তম পদক্ষেপ নির্বাচন করা অত্যন্ত প্রয়োজন।

আরও পড়ুন: ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যগুলি আলোচনা কর ?

ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব (Importance of management):

 যে কোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব জানা খুবই অপরিহার্য, সেগুলি হল –

১. লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য অর্জন (Achieving goals and objectives) :

যে কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করা। ব্যবস্থাপনা সুস্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলি নির্ধারণে সাহায্য করে । পরিকল্পনা, সংগঠিত, নেতৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পরিচালকরা নিশ্চিত করে যে প্রতিষ্ঠানটি নির্দিষ্ট অবস্থায় থাকে এবং দক্ষতার সাথে তার উদ্দেশ্যগুলি পূরণ করে ।

২. সম্পদের দক্ষ ব্যবহার (Efficient Resource Utilization):

কোনো প্রতিষ্ঠানের সম্পদ দক্ষ ব্যবহারের মাধ্যমে সম্পদের অপচয় রোধ করা যায় । ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে প্রতিষ্ঠানের কর্মী দক্ষতা, অর্থ, এবং উপকরণ সহ সমস্ত সম্পদ কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হয় । এর ফলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং প্রতিষ্ঠানটি তার সর্বাধিক লাভ করে ।  

৩.  একটি শক্তিশালী দল গড়ে তোলা (Building a Strong Team):

একটি শক্তিশালী কর্মীর দল প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে পারে । কার্যকরী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কর্মীদের মধ্যে একত্রিত বা দলগত কাজকে উৎসাহিত করে ইতিবাচক (positive) কাজের পরিবেশ এবং কর্মীবাহিনী তৈরি করা যায় ।

৪. পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেওয়া (Adapting to Change):

ব্যবসার বিশ্বে ক্রমাগত পরিবর্তন হওয়ায় ব্যবস্থাপনাকে সেই পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে হয় । যাতে পরিবর্তনগত কাঠামো থেকে ব্যবসাকে রক্ষা করা যায় । উদাহরণস্বরূপ – নতুন প্রযুক্তিগত গ্রহনের পরিবর্তন, বাজারের প্রবণতগুলির পরিবর্তন, এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তন ইত্যাদি ।

৬. সমাজের উন্নয়নে সাহায্য (helps in social development):

দক্ষ ব্যবস্থাপনা সাংগঠনিক উন্নয়নের সাথে সমাজের উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে । যেমন – সংস্থাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সূলভ মূল্যে ভালোমানের পন্য বা সেবা প্রদান এবং উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করে অর্থনীতিতে অবদান রাখে ।

৫. উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি (Productivity):

দক্ষ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কর্মীদের নির্দিষ্ট কাজের দায়িত্ব অর্পণ, কর্মদক্ষতা নিরীক্ষণ এবং উপকরণের সঠিক ব্যবহার করে সেই প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা বাড়ায় । এর ফলে একটি নির্দিষ্ট খরচের মধ্যে সর্বাধিক উৎপাদন করা যায় ।

৭. ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য অর্জন (Personal objectives):

ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য অর্জনের সাথে কর্মীদের মধ্যে ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য অর্জনেও সহায়তা করে। যেমন – কর্মীদের বেতন বৃদ্ধির সাথে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্ম দক্ষতার উন্নতি ইত্যাদি ।

ব্যবস্থাপনার কার্যাবলী (Functions of management):

ব্যবস্থাপনা কাকে বলে: বৈশিষ্ট, গুরুত্ব এবং কার্যাবলী বিস্তারিত আলোচনা

ব্যবস্থাপনার কার্যাবলী (Functions)  প্রধানত পাঁচটি মৌলিক ধাপে বিভক্ত: পরিকল্পনা, সংগঠন, কর্মী, নেতৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ। প্রতিটি ধাপের কার্যাবলী নিম্নরূপ:

১. পরিকল্পনা (Planning):

পরিকল্পনা হলো ব্যবস্থাপনার প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ কার্যক্রম নির্ধারণ করা হয়। পরিকল্পনার সাহায্যে প্রতিষ্ঠানকে কি করতে হবে, কিভাবে করতে হবে, এবং কখন করতে হবে ইত্যাদি লক্ষ্য নির্ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় । এর ফলে প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য একটি নির্দিষ্ট মানচিত্র তৈরি করা যায় ।

২. সংগঠন (Organizing):

সংগঠন ধাপে কার্যক্রমগুলিকে সুশৃঙ্খলভাবে বিন্যস্ত করা হয়। এটি মানুষের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন এবং সম্পর্ক তৈরি করার কাজ করে। এর মধ্যে রয়েছে কাজের বিভাজন, অধিকার নির্ধারণ, এবং সংস্থার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহের ব্যবস্থা করা।

৩. কর্মী (Staffing):  

কর্মী হলো প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল সংগ্রহ, নির্বাচন, প্রশিক্ষণ এবং তাদেরকে যথাযথ কাজে নিযুক্ত করার প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে সঠিক ব্যক্তিকে সঠিক স্থানে নিয়োগ করা হয়, যাতে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম দক্ষতার সাথে সম্পন্ন হয়।

এই ধাপের মধ্যে রয়েছে:

  • নিয়োগ: প্রয়োজনীয় দক্ষতা এবং যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মী নিয়োগ করা।
  • নির্বাচন: সঠিক প্রার্থীদের মধ্য থেকে উপযুক্ত কর্মী নির্বাচন করা।
  • প্রশিক্ষণ: কর্মীদের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করা।
  • উন্নয়ন: কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য তাদের জন্য উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
  • বেতন নির্ধারণ: কর্মীদের যোগ্যতা অনুযায়ী বেতন ও সুবিধা প্রদান করা।

৪. নেতৃত্বদান (Leading):

নেতৃত্বদান ধাপে ব্যবস্থাপকরা তাদের কর্মীদের মধ্যে উৎসাহ, অনুপ্রেরণা, এবং নির্দেশনা প্রদান করেন। এই ধাপে ব্যবস্থাপকের প্রধান ভূমিকা হলো কর্মীদের মধ্যে আস্থা স্থাপন এবং তাদেরকে উদ্দেশ্য পূরণের জন্য উৎসাহিত করা। এটি কার্যকর যোগাযোগ, সমস্যার সমাধান, এবং দিকনির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে অর্জিত হয়।

৫. নিয়ন্ত্রণ (Controlling):

নিয়ন্ত্রণ ধাপে ব্যবস্থাপকরা নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুসারে কার্যক্রমগুলো সম্পন্ন হচ্ছে কিনা তা তদারকি করেন। এর মাধ্যমে মান, প্রক্রিয়া এবং ফলাফল পর্যালোচনা করা হয় এবং যদি কোনো বিচ্যুতি ঘটে তবে তা সংশোধনের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এর প্রধান লক্ষ্য হলো নিশ্চিত করা যে সংস্থার কার্যক্রম নির্ধারিত লক্ষ্য অনুযায়ী সম্পন্ন হচ্ছে।

এই পাঁচটি কার্যাবলী একে অপরের সাথে সম্পর্কিত এবং ধারাবাহিকভাবে প্রয়োগ করতে হয় যাতে প্রতিষ্ঠান তার লক্ষ্য অর্জনে সফল হতে পারে।

উপসংহার

উপরোক্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে ব্যবস্থাপনা ছাড়া কোন সংস্থা বা প্রতিস্থান তার উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য অর্জন করা যায় না । অর্থাৎ ব্যবস্থাপনার সাহায্যে সংস্থান বা প্রতিস্থানের পরিকল্পনা, সংগঠিত, কর্মী, নেতৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়।


Share Knowledge

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top