
ব্যবস্থাপনার প্রাথমিক কাজ হল পরিকল্পনা করা । পরিকল্পনা ছাড়া প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিগত লক্ষ্যকে সঠিক পথে নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব । তাই পরিকল্পনা সম্পর্কে জানার জন্য় পরিকল্পনা কি বা কাকে বলে, এর বৈশিষ্ট্য, গুরুত্ব এবং সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি জানা অত্যন্ত অপরিহার্য ।
table of contents
পরিকল্পনা কি বা কাকে বলে ?
পরিকল্পনা হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার সাহায্যে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভবিষ্যৎ লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা । আবার সেই উদ্দেশ্যগুলি অর্জনের জন্য বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের মধ্যে থেকে সর্বোত্তম সম্ভাব্য ক্রিয়াকলাপ বা বিকল্প নির্বাচন করা ।
অর্থাৎ, ব্যক্তিগত বা সাংগঠনিক ভবিষ্যৎ লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নির্ধারণ করাকে পরিকল্পনা বলে ।
উদাহরণস্বরূপ – ব্যক্তিগত দিক থেকে পরিকল্পনা, যেমন – একজন ছাত্র বা ছাত্রী বার্ষিক পরীক্ষাতে ৯০ শতাংশ নম্বর পাওয়ার জন্য কি পড়তে হবে, কিভাবে পড়তে হবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিষয়গুলি কিভাবে শেষ করবে ইত্যাদি পরিকল্পনা করা ।
আবার অন্যদিকে, সাংগঠনিক দিক থেকে পরিকল্পনা, যেমন – উৎপাদন কোম্পানি (manufacturing company)-কে কোন পন্য এবং কিভাবে উৎপাদন করবে, কত পরিমান উৎপাদন করবে এবং পন্যগুলি কোথায় বা কাকে বিক্রয় করবে ইত্যাদি পরিকল্পনা করা ।
পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্যগুলি (features/nature/characteristics of planning):
পরিকল্পনা যে কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য নির্ধারণ এবং অর্জনে প্রয়োজনীয় কৌশল ও পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করে । পরিকল্পনার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগুলি রয়েছে, যেটি ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করে ।
১। লক্ষ্য অর্জন (achieving goal):
পরিকল্পনার মুখ্য কাজ হল নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে অর্জন করা । প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘমেয়াদী বা স্বল্পমেয়াদী উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য পূরণ করার জন্য পরিকল্পনা তৈরি করা হয় । এর ফলে প্রতিস্থানকে সঠিক পথে পরিচালিত করা যায় ।
২। ভবিষ্যৎ নির্ধারণ (Determine the future):
পরিকল্পনা ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ঝুকি এবং সুযোগগুলিকে মাথায় রেখে তৈরি করা হয় । ভবিষ্যতে কি কি সীমাবদ্ধতা আসবে এবং সেটা কিভাবে রোধ করবে তা পরিকল্পনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয় ।
৩। ব্যবস্থাপনার প্রাথমিক কাজ (primary function of management):
পরিকল্পনা হল কোনো প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনার মূল ভিত্তি । পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রতিস্থানকে কিভাবে কাজ করবে, কিভাবে তাদের সম্পদ এবং সময় ব্যবহার করবে ইত্যাদি নির্ধারণ করা । পরিকল্পনা ছাড়া প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমগুলি সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত করা প্রায় অসম্ভব ।
৪। চলমান প্রক্রিয়া (continuous process):
পরিকল্পনা একটি চলমান প্রক্রিয়া । এটি একবার তৈরি করে শেষ হয়ে যায় না, বরং সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হলে পরিকল্পনাতেও পরিবর্তিত করা হয় ।
৫। পরিকল্পনা সর্বত্র প্রযোজ্য (Pervasive):
পরিকল্পনা কোনও একটি নির্দিষ্ট স্তরে সীমিত নয় । এটি প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক স্তরে, বিভাগে এবং কর্মক্ষেত্রে প্রযোজ্য । উচ্চ পর্যায়ের ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে নিম্ন স্তরের কাজ পর্যন্ত পরিকল্পনা প্রয়োজন হয় ।
৬। সিদ্ধান্ত গ্রহনে সাহায্য (involves decision making):
পরিকল্পনা প্রতিস্থানের যে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহনে সাহায্য করে । কারণ পরিকল্পনা বিভিন্ন বিকল্পগুলির মধ্যে সর্বোত্তম সমাধান বেছে নিয়ে প্রতিষ্ঠানের পরিচালনাকে আরও দক্ষ করে তুলে ।
৭। মানসিক প্রকিয়া (mental excercise):
পরিকল্পনা একটি মানসিক দক্ষতার সঙ্গে যুক্ত কার্যক্রম । তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং ভবিষ্যতের জন্য কৌশল ও পদক্ষেপ নির্ধারণ করার সময় মানসিক দক্ষতা প্রয়োগ করতে হয় । এটি চিন্তাশীল এবং সৃজনশীল হওয়ার প্রয়োজন হয় ।
৮। পরিকল্পনার সময়সীমা (Planning period):
পরিকল্পনা একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার জন্য তৈরি করা হয়, যেমন – দীর্ঘমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী এবং স্বল্পমেয়াদী । এই নির্দিষ্ট সময়সীমা অনুযায়ী লক্ষ্য পূরণের জন্য কার্যক্রমগুলি নির্ধারণ করা হয় ।
৯। বাস্তবসম্মত ও প্রয়োগযোগ্য (practical and applicable):
পরিকল্পনা কার্যকরী হওয়ার জন্য অবশ্যই বাস্তবসম্মত হতে হবে । কারণ কার্যক্রম গুলিকে বাস্তবে প্রয়োগযোগ্য না হলে পরিকল্পনার কোনো মানে নেই । তাই প্রতিষ্ঠানের সম্পদ, অর্থ, কর্মী এবং সময় ইত্যাদি বিষয়গুলিকে মাথায় রেখে বাস্তবসম্মত বা প্রয়োগযোগ্য পরিকল্পনা তৈরি করা হয় ।
পরিকল্পনার গুরুত্বগুলি (Importance of planning):
পরিকল্পনা একটি ব্যবস্থাপনার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমগুলিকে সুশৃঙ্খল এবং সফলভাবে চালাতে সহায়তা করে । ভবিষ্যতের লক্ষ্য নির্ধারণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহনে ব্যবস্থাপনায় পরিকল্পনার গুরুত্বগুলি অপরিহার্য । সেগুলি হল –
১। দিকনির্দেশনা প্রদান করে (provides direction):
পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে দিক নির্দেশনা প্রদান করে । দিক নির্দেশনা ছাড়া কোনও প্রতিস্থান সঠিক পথে পরিচালিত করা প্রায় অসম্ভব।
২। অনিশ্চয়তার ঝুঁকি কমায় (reduce the risks of uncertainty):
বাজারের পরিবর্তন এবং অনিশ্চয়তার কারণে প্রতিষ্ঠানের সামনে অনেক রকমের ঝুঁকি আসতে পারে । পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠানের সম্ভাব্য ঝুঁকি চিহ্নিত করে এবং তা মোকাবিলার জন্য সম্ভাব্য সমাধান নির্বাচন করে প্রতিষ্ঠানে ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে ।
৩। অপ্রয়োজনীয় কাজ বা কার্যকলাপ কমায় (Reduces unnecessary tasks or activities):
পরিকল্পনার সাহায্যে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কার্যক্রমগুলি দিক নির্দেশ পাওয়া যায় । ফলে প্রতিস্থানকে অপ্রয়োজনীয় কার্যকলাপ থেকে রোধ করে কর্মদক্ষতার অপচয় কমানো যায় ।
৪। উদ্ভাবনী চিন্তার উন্নয়ন করা (promotes innovation ideas):
পরিকল্পনার সময় নতুন কৌশল এবং পদ্ধতির চিন্তা ধারণা করা হয় । যা প্রতিষ্ঠানে উদ্ভাবনী চিন্তার বিকাশ ঘটায় । সঠিক পরিকল্পনা নতুন ধারণা এবং উদ্ভাবনী সমাধানের পথ প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতিতে সহায়তা করে ।
৫। সিদ্ধান্ত গ্রহনে সহজতর করা (facilitate decision making):
পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যবস্থাপনায় সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য সহজ হয়ে পড়েছে । কারণ পরিকল্পনা ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার সাথে তথ্য বিশ্লেষণ করে সর্বোত্তম সম্ভাব্য সমাধান খুজে বের করেন । ফলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ব্যবস্থাপনার কাছে সহজ হয়ে পড়ে ।
৬। নিয়ন্ত্রণের মান স্থাপন করা (established standard for controlling):
পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের কার্যকলাপের মান নিয়ন্ত্রণ করা যায় । এর সাহায্যে জানা যায়, যে পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যক্রমগুলি হচ্ছে কিনা এবং সেই কার্যক্রমগুলির মূল্যায়ন করা ।
৭। সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার (utilization of resources):
পরিকল্পনার আরেকটি মুখ্য গুরুত্ব হল সম্পদের সঠিক ব্যবহার করা । সম্পদের সর্বোত্তম বা সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে সম্পদ, যেমন – মানবসম্পদ, অর্থ, এবং সময় ইত্যাদি অপচয় রোধ করা যায় ।
পরিকল্পনার সীমাবদ্ধতা (Limitations of planning):
ব্যবস্থাপনায় পরিকল্পনা যদিও প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমগুলি পরিচালনা করার জন্য উপযোগী হলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে । এই সীমাবদ্ধতাগুলি পরিকল্পনাকে সব পরিস্থিতিতে কার্যকর হতে বাধা দেয় । সেই সীমাবদ্ধতাগুলি হল –
১। অনমনীয়তা (Rigidity):
পরিকল্পনা সাধারণত নির্দিষ্ট সময়সীমা এবং কাঠামোর মধ্যে তৈরি করা হয় । বাজারের পরিবর্তন বা কোনও অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির কারণে পরিকল্পনার প্রয়োজন হলেও তা করা সম্ভব হয় না । যা অনমনীয়তার স্বীকার দেখা দেয় ।
২। পরিবর্তনশীল পরিবেশ (Dynamic environment):
বাজারের মধ্যে পরিবর্তনশীলতা, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং প্রতিযোগিতার কৌশল ইত্যাদি দ্রুত পরিবর্তিত হয় । বাজারের দ্রুত পরিবর্তনশীল হওয়ায় পরিকল্পনা এই পরিবর্তিত পরিবেশে সবসময় কার্যকর হয় না ।
৩। সৃজনশীলতা কমায় (Reduces creativity):
উচ্চ পর্যায়ের দ্বারা সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানে কাজের নিয়ম এবং চাপ থাকায় কর্মচারীদের মধ্যে সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনের ধারণাকে সীমিত করে । এর ফলে কর্মচারীদের মধ্যে নতুন পদ্ধতি বা কৌশলের ধারণা ও ব্যবহার করতে বাধাগ্রস্ত হয়।
৪। ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ (Huge cost and time-consuming):
সঠিক পরিকল্পনা তৈরি করতে প্রচুর সময়, শ্রম এবং অর্থ ব্যয় হয় । পরিকল্পনা যদি সময় মতো না হলে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমগুলি ব্যর্থ হতে পারে । আবার, অন্যদিকে পরিকল্পনা সময় মতো করা হলেও অনেক ক্ষেত্রে কার্যক্রমগুলি প্রয়োগ করার জন্য বিশাল অর্থের সমস্যা দেখা দেয় ।
৫। সাফল্যে নিশ্চয়তা নেই (does not guarantee success):
পরিকল্পনা সঠিকভাবে করা হলেও অনেক সময় সাফল্য নিশ্চিত হয় না । কারণ বাহ্যিক পরিবেশের পরিবর্তন, প্রতিযোগিতাদের কৌশল এবং অন্যান্য অপ্রত্যাশিত ঘটনাগুলি পরিকল্পনার সফলতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে ।
৭। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বাহ্যিক সীমাবদ্ধতা (External limitations):
পরিকল্পনার অসফলতার বা ব্যর্থতার পেছনে কিছু বাহ্যিক পরিবেশের উপর নির্ভর করে । সেগুলি হল-
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ (natural calamities), যেমন- সুনামি, বন্যা, ভুমিকম্প ইত্যাদি,
- সরকারি নীতির পরিবর্তন (changes in government policies),
- প্রতিযোগিতাদের নতুন কৌশল (strategies of competitors),
- প্রযুক্তিগত পরিবর্তন (technological changes),
- ভোক্তাদের রুচির পরিবর্তন (changes in consumer taste) ইত্যাদি ।
এই সব বাহ্যিক সীমাবদ্ধতা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকায় সঠিকভাবে পরিকল্পনা করলেও সফলতার পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে ।