আকবরের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা : আলোচনা, উপকারিতা, সীমাবদ্ধতা | Land Revenue System of Akbar

Share Knowledge

আকবরের ভূমি রাজস্ব বাবস্থায় আকবর জায়গিরদারদের সাথে রাজস্ব সংগ্রহের জন্য আলাপ

ভূমিকা:

আকবরের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা :

আকবরের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য এবং নীতিগুলির একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা এখানে দেওয়া হল:

  1. জাবত ব্যবস্থা: আকবরের  জাবত ব্যবস্থা  ছিল একটি নির্দিষ্ট রাজস্ব মূল্যায়ন করার ব্যবস্থা । এই ব্যবস্থার মধ্যমে জমির গড় উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রাজস্ব চাহিদা নির্ধারণ করা হয় । সাধারণত, এটি ১০ থেকে ২০ বছরের জন্য নির্ধারিত হয় ।
  2. জমির সঠিক পরিমাপ ও মূল্যায়ন : আকবরের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার প্রথম কাজ হল সঠিকভাবে জমির পরিমাপ করা। বিঘা বা একর (acre)-এর  মতো একক ব্যবহার করে চাষের জমি পরিমাপ করা হয় । রাজস্ব মূল্যায়ন করার জন্য জমির গুণমান, উর্বরতা এবং উৎপাদিত ফসলের উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়।
  3. হারের প্রমিতকরণ: আকবরের প্রশাসনকালে বিভিন্ন অঞ্চলে রাজস্ব মূল্যায়নের হারকে প্রমিত করে। এটি রাজস্ব সংগ্রহ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অভিন্নতা এবং পূর্বাভাসযোগ্যতা আনতে সাহায্য করেছে।
  4. রাজস্ব নিয়োগ: আকবর জায়গিরদারি ব্যবস্থা চালু করেছিলেন যার মাধমে কর্মকর্তা বা অভিজাতদের নির্দিষ্ট অঞ্চলে রাজস্ব সংগ্রহের অধিকার প্রধান করা হয়েছিল। এর বদলে সাম্রাজ্যে তাদের সেবা প্রধান করতে হতো এবং কর্মদক্ষতার উপর ভিত্তি করে পুনঃনিযুক্ত করা যেতে পারে। যার ফলে কৃষকদের রাজস্ব দিতে অযথা কষ্ট করতে হতো না ।
  5. মওকুফ ও বিলুপ্তি: এই ব্যবস্থাই আকবর প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন খরা বা বন্যার সময় মওকুফ রাজি  করে তার রাজস্ব নীতিতে নমনীয়তা দেখিয়েছিলেন। তিনি কিছু নিপীড়নমূলক করও বাতিল করেছিলেন যা কৃষকদের বোঝা হয়ে পড়েছিল।
  6. কৃষিতে উৎসাহ: আকবরের রাজস্ব ব্যবস্থাই  কৃষি  উৎপাদনশীলতা  এবং উন্নয়নকে উৎসাহিত  করার জন্য তৈরী করা হয়েছিল। তিনি সেচ প্রকল্পের সূচনা, খাল নির্মাণ  এবং তুলার মতো অর্থকরী ফসলের চাষের প্রচার করেন
  7. স্থানীয় প্রশাসন: আকবর একটি বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যার মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে রাজস্ব সংগ্রহ করা যায় ।  রাজস্ব আদায় পরিচালনা এবং নিজ নিজ অঞ্চলে  আইনশৃঙ্খলা মেনে চলার জন্য ‘আমিল’ নামক কর্মকর্তাদের নিয়োগ করা হয়।

উপকারিতা (Benefits):

  • কর ব্যবস্থায় নমনীয়তা: এই ব্যবস্থায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যদি ফসলের ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে কৃষকদের কর ক্ষমা করার মতো  অনুমতি আছে। যা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের শান্তি প্রদান করে এবং অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে প্রতিরোধ করে।
  • পূর্বাভাস এবং স্থিতিশীলতা: রাজস্বের স্থির মূল্যায়ন কৃষক এবং রাজ্য উভয় ক্ষেত্রে  স্থিতিশীলতা দেখা যায়। রাজস্বের সঠিক পরিমাণ জানার ফলে কৃষকরা  নিশ্চিন্তে কর বৃদ্ধির ভয় ছাড়াই তাদের কৃষি কার্যক্রমের পরিকল্পনা করতে পারে।
  • স্থির রাজস্ব ভাগ: আকবরের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থায়  কৃষি পণ্য থেকে  রাজস্বের জন্য নির্দিষ্ট অংশ নির্ধারণ করেছিলেন।  সাধারণত, এটি মোট উৎপাদনের ১/৩ অংশ থেকে অর্ধেক পর্যন্ত হয়।

আরও পড়ুন : ইকতা ব্যবস্থা কি ? কে ভারতে এটি প্রথম চালু করেন ?

সীমাবদ্ধতা (Limitations):

এই ব্যবস্থায় অনেক সুবিধা থাকা সত্ত্বেও  বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল, সেগুলি হল :

  1. ভারী কর : রাজস্বের ন্যায্যতা স্থির করার পরেও ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা তবু কৃষকদের উপর ভারী করের বোঝা চাপিয়ে দিতে পারে।  যেমন -খারাপ ফসল বা অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে কৃষকদের কষ্ট ভোগ করতে হয়।   
  2. দুর্নীতি ও শোষণ: রাজস্ব নিয়োগের ব্যবস্থার (জায়গিরদারি ব্যবস্থা) ফলে  স্থানীয় কর্মকর্তাদের দ্বারা প্রায়ই দুর্নীতি ও শোষণের দিকে পরিচালিত হয়।  কিছু কর্মকর্তা বা জায়গিরদার ক্ষমতার অপব্যবহার করে নির্ধারিত রাজস্বের চেয়ে বেশি নিতেন।  যার ফলে কৃষকদের কষ্ট ভোগ করতে হয় এবং সেই ব্যবস্থার সুবিধাগুলিকে দুর্বল করে।
  3. সীমিত পরিধি: যদিও কৃষি জমির ক্ষেত্রে ভূমি  রাজস্ব ব্যবস্থা কর্যকর ছিল, কিন্তু বাণিজ্য, পরিষেবা বা শিল্পের মতো ইত্যাদি উৎস থেকে রাজস্ব সংগ্রহে কোনো সম্বোধন করেনি। এই সীমিত পরিধির অর্থ হল করের বোঝায় পড়া।
  4. কৃষি অর্থনীতির উপর নির্ভরশীলতা: রাজস্বের প্রধান উৎস হিসেবে কৃষির উপর বেশি নির্ভশীলতা মুঘল অর্থনীতিকে দুর্বল করে তুলে, যখন কৃষি উৎপাদনের এবং বাজারের অবস্থা অস্থায়ী বা ওঠানামা সৃষ্টি করে। এই নির্ভরতা অর্থনীতির বহুমুখীকরণ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির সীমিত সুযোগকে বাধাগ্রস্ত করে।
  5. অপর্যাপ্ত তথ্য ও মূল্যায়ন: সঠিকভাবে ভূমি পরিমাপ এবং রাজস্ব মূল্যায়নে নির্দিষ্ট কর্মকর্তা এবং স্থানীয় প্রশাসকদের দক্ষতার উপর নির্বর করে। ভুল মূল্যায়ন বা অয্যোগ তথ্যের কারণে অন্যায্য কর এবং প্রশাসনিকদের উপর অদক্ষতা দেখা দেয়।

উপসংহার (conclusion):

আকবরের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থায় রাজস্ব সংগ্রহে অভিন্নতা, ন্যায্যতা এবং দক্ষতা আনার লক্ষ্যে মুঘল সাম্রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রবর্তন করেছিল। যদিও এই ব্যবস্থায় বিভিন্ন সুবিধা গুলি রয়েছে  এবং কিছু সীমাবদ্বতাও দেখা দেয় এই ব্যবস্থাতে ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও মুঘল সাম্রাজ্যে পরবর্তী রাজস্ব প্রশাসনের ভিত্তি স্থাপন করেছিল এবং ভারতীয় উপমহাদেশের কৃষি অর্থনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল।


Share Knowledge

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top